হ্যালো, কে বলছেন?
হ্যালো, কে বলছেন?
অনেকদিন পর ক্যান্টিনে বসে ডালপুরি আর আলুর চপ স্যান্ডউইচ করে খাচ্ছি। ডালপুরি আর আলুর চপ এভাবে খেতে আমার বেশ ভালো লাগে। খাওয়া শেষে এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে পড়লাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে, ক্যাম্পাসে তেমন কেউ নেই। যারা আছে তাদের অধিকাংশই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
হাঁটতে হাঁটতে ফুসকাওয়ালা মামার দোকানের কাছে চলে আসলাম। মামা আমাকে দেখে একটু মুচকি হেসে বললো, 'আঙ্কেল এক প্লেট চটপটি দেই?' আমি না বোধক মাথা নেড়ে একটা টুলে বসলাম। দোকানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ফুসকাওয়ালা মামার মাথার উপর এক ঝাঁক মশা উড়ছে। আমার মাথার উপরও হয়তো এমন এক ঝাঁক মশা উড়ছে!
পকেট থেকে ফোনটা বের করে কতক্ষণ ফেসবুক স্ক্রল করলাম। ফেসবুকের এই আনলিমিটেড স্ক্রল মাঝে মাঝে আমার কাছে বেশ বিরক্ত লাগে, আরে ভাই সবকিছুর একটা শেষ থাকে, তুই সামান্য একটা অ্যাপ! তোর স্ক্রলিং কেনো আনলিমিটেড হতে হবে!
হঠাৎ করেই সন্ধ্যা নেমে এলো, হঠাৎ বললে অবশ্য ভুল বলা হবে, আমি একটু আগেও আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সন্ধ্যার আগমন দেখছিলাম। ফুসকাওয়ালা মামা দোকান বন্ধ করে দিচ্ছেন। আমি উঠে পড়লাম। ক্যাম্পাস থেকে শহরে যাওয়ার ট্রেনটা ছাড়বে ৩০ মিনিট পর। ট্রেন পর্যন্ত হেঁটে যেতে ১৫ মিনিট সময় লাগবে আমার। এই ১৫ মিনিট শুধু হেঁটে হেঁটে কাটানো আমার জন্য কষ্টকর। আমি নিজের কষ্ট একদম সহ্য করতে পারি না!
হাঁটতে হাঁটতে সূচনাকে ফোন দিলাম। আমার ব্যাচমেট হলেও সূচনা অন্য ডিপার্টমেন্টে পড়ে। তার সাথে আমার কথা হয় কালেভদ্রে, দেখা হয় তার চেয়েও কম। কিন্তু যখনই কথা বলি মনে হয় একটু আগেই মনে হয় কথা বলেছিলাম ওর সাথে! তার সাথে কথা বলার টপিকগুলোও অদ্ভুত! বেশীরভাগ কথাই অবশ্য আমি বলি, তাই অদ্ভুত টপিকগুলো নিয়ে আলোচনার একক কৃতিত্ব আমার! মানুষ সাধারণত শোনার চেয়ে বলতে বেশী পছন্দ করে, কিন্তু সূচনা এক্ষেত্রে একদম উল্টো, তার সবচেয়ে ভালো গুণ সে খুব ভালো শ্রোতা।
তিন বার রিং পরার পর সূচনা ফোনটা ধরলো। ধরেই সেই পরিচিত কণ্ঠে বললো, 'হ্যালো, শাফকাত, বলো তোমার মন কেনো খারাপ?' আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। সাধারণত আমার মন খারাপ থাকলেই আমি ওকে ফোন দেই। একটা সময় বিষয়টা সে ধরতে পেরেছে এবং এরপর থেকে ফোন ধরেই সে এই এক ডায়লগ দেয়া শুরু করেছে। এতে অবশ্য আমার মন খারাপ ভাবটা একটু কমে যায়! আজকে আমার মন খারাপের কারণটা বেশ অদ্ভুত! আজকে সন্ধ্যা নামের মুহূর্তটা একটু বেশীই অন্ধকারাচ্ছন্ন লেগেছে আমার কাছে, আর তা দেখেই আমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেছে! সূচনাকে একথা বলতেই সে খুব স্বাভাবিকভাবে আমাকে সন্ধ্যার অন্ধকার নিয়ে ছোটখাটো একটা লেকচার দিলো। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনে জিজ্ঞেস করলাম, 'আজকে তোমার মন কেনো খারাপ? তুমি তো এতো কথা বলো না! শুধু মন খারাপ থাকলেই বলো।' আমার কথা শুনে সূচনা হাসলো কি হাসলো না বুঝলাম না। কিন্তু সে কিছু বললো না। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে টুকটাক কথা বললাম। স্টেশনের কাছাকাছি এসে তার থেকে বিদায় নিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।
ট্রেনে উঠে বসলাম। ঠিক এক ঘণ্টা সময় লাগবে শহরে পৌঁছুতে। ট্রেনে বসে সূচনার কথা ভেবে একটু খারাপ লাগছে আমার। সূচনা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত, তাই সাম্প্রতিক সব স্মৃতি মনে রাখা তার জন্য খুব কষ্টকর। খুব সম্ভবত এ কারণে আমি আমার খারাপ লাগা অনুভূতিগুলো ওর সাথে শেয়ার করি! আমার কষ্টের স্মৃতি ওকে ভাবালেও খুব বেশী সময় হয়তো ভাবাবে না!
সূচনা সাম্প্রতিক অনেক কিছু ভুলে গেলেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে এখনো আমার নাম বা আমাকে ভুলে যায় নি! এখনো ফোন ধরেই বলবে, 'হ্যালো, শাফকাত, বলো তোমার মন কেনো খারাপ?'
মাঝে মাঝে ভাবি, কোনোদিন হয়তো সে ফোনের ওপর পাশ থেকে বলবে, 'হ্যালো, কে বলছেন? আপনার নাম্বারটা আমার মোবাইলে শাফকাত নামে সেইভ করা আছে, কিন্তু আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না, স্যরি!' সেদিন হয়তো আমার অনেক অনেক কষ্ট লাগবে! ইচ্ছে করবে সূচনাকে আরো একবার ফোন করে বলি আমার খুব মন খারাপ! কিন্তু আমি জানি তা আর বলা হবে না! সেদিন সূচনার সাথে আমার কথাদের ইতি টানা হবে.......
সমাপ্ত