০৭ জুলাই, ২০৫৬। ভোর ৪:০০ টা।
সুলিভান তার কস্কোভাস রোডের বাসার বারান্দায় একা বসে আছে। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টের নিচে একটা কুকুর ঘুমোচ্ছে। আশেপাশের অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা জীবনের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ তৈরি করে মাঝে মাঝে! বছর চারেক হলো কস্কোভাস রোডের এই বাড়িটা সুলিভান কিনেছে। শহর থেকে অনেকটা দূরে পাহাড় ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে এই বাড়িটা। প্রথম দেখায় বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছিল সুলিভানের। তার গবেষণার জন্য এমন নীরবতা বেশ সহায়তা করবে বলেই তার বিশ্বাস।
অনেকদিন ধরে খুব অদ্ভুত একটা বিষয়ে সুলিভান গবেষণা করে আসছে, সময়টা বেশ লম্বা, প্রায় ৯ বছর! এই ৯ টা বছর তার প্রতিটা মুহুর্ত কেটেছে টান টান উত্তেজনায়, কতবার যে তার গবেষণার পদ্ধতি বদলাতে হয়েছে তার হিসেব নেই। সুলিভান চেয়েছে সত্যিকারের অমরত্ব লাভ করতে! পৃথিবী যতদিন থাকবে ঠিক ততদিন সে বাঁচতে চায়!
গবেষণার শুরুর দিকটা খুব কঠিন ছিলো সুলিভানের জন্য, তার কাছের সবাই তার এই অমরত্ব প্রাপ্তির পেছনে ছুটে চলাকে স্রেফ পাগলামি বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। খুব মনে কষ্ট পেলেও সুলিভান কাউকে কিছু বলতো না, কারণ এই অমরত্ব সে চেয়েছিল তার জন্য! প্রথম প্রথম সময়ের সাথে শরীরের বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য অনেক গবেষণা করেছিল সুলিভান, কিন্তু একটা সময় সে বুঝতে পারে এই দেহের বুড়িয়ে যাওয়ার সময়টাকে দীর্ঘায়িত করা গেলেও দেহকে অমরত্ব দেয়া সম্ভব নয়। এরপরই সুলিভানের মাথায় এলো সেই চমৎকার আইডিয়া! তার সবটা স্মৃতি সে যদি আরেকটা নতুন শরীরে ধারণ করাতে পারে তাহলে তো তার অমরত্ব লাভে আর কোনো সমস্যাই নেই! সুলিভান মানেই সুলিভানের মস্তিষ্কপ্রসূত সব চিন্তা-চেতনা, তার সব স্মৃতি, রক্ত মাংসের সুলিভান একটা গৌণ বিষয়!
তার গবেষণার সবচেয়ে কঠিন অংশ ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য মানুষ জোগাড় করা। এই গবেষণার জন্য গিনিপিগ একটাই, মানুষ!!! সুলিভান তার গবেষণার সাবজেক্টের সব স্মৃতি মুছে দিয়ে তার নিজের স্মৃতির একটা কপি সেই মানুষের মাঝে প্রবেশ করাতো। এজন্য সে ব্যবহার করে তার উদ্ভাবিত Brain Emulation ডিভাইস। প্রথম দিকে তার ডিভাইসটি ঠিকঠাক কাজ করে নি, ২১ টি নিরীহ সাবজেক্ট তাদের সব স্মৃতি হারিয়ে শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিল। এইসব মৃত সাবজেক্ট নিয়ে সে খুব বিপাকে পড়তে পারতো, কিন্তু তার আগেই সে শহর থেকে দূরে কস্কোভাস রোডের এই বাড়িটা কিনেছে। পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে মাঝে মাঝে আগুন জ্বলতে দেখা যায়, সুলিভানের বারবিকিউ পার্টির সে আগুন দেখা যায় দূর দূরান্ত থেকে, কিন্তু জনমানবহীন এই অঞ্চলে কেউ যে নেই দেখার! অমরত্ব লাভের পথে টুকটাক বারবিকিউ পার্টি পরবর্তী প্রজন্ম মেনে নিবে বলেই সুলিভানের বিশ্বাস।
সারাটা রাত ধরে সুলিভান তার বারান্দায় একটা বিশেষ কারণে বসে ছিলো। যে সাবজেক্টটা আজ তার বাড়িতে রয়েছে তাকে পরবর্তী ৪০-৫০ বছরের জন্য সুলিভান হিসেবে ভাবতেই তার ভালো লাগছে। এই সাবজেক্টটা একদম পারফেক্ট তার স্মৃতি ধারণের জন্য!
সুলিভানের বিশ্বাস তার Brain Emulation ডিভাইসটি ১০০% সঠিকভাবেই তার সব স্মৃতি আপলোড করতে সক্ষম। শেষবারের পরীক্ষায় সে প্রায় সফল হয়েই গিয়েছিল, কিন্তু শেষদিকে সাবজেক্টটা আর টিকে থাকতে পারে নি। অবশ্য সাবজেক্টটাকে সুলিভানের তেমন একটা ভালোও লাগে নি।
সুলিভান আস্তে আস্তে তার ল্যাবে প্রবেশ করলো, এই দেহ নিয়ে আজই শেষবার তার প্রিয় এই ল্যাবে প্রবেশ! সুলিভান প্ল্যান করলো Brain Emulation ডিভাইসে সে তার স্মৃতির শেষ ১০ টা মিনিট নতুন সাবজেক্টে আপলোড না করার কমান্ড দিয়ে যাবে, আর তার আগের ৫ মিনিট ধরে সিদ্ধান্ত নিবে চোখ খুলে সামনের সাবজেক্টকে কিভাবে সে খুন করবে! সে কি পারবে তার নিজের এতদিনের দেহটাকে খুন করতে!!! তাকে পারতেই হবে, তার এতদিনের অমরত্ব লাভের স্বপ্ন তাকে পূরণ করতেই হবে!
নতুন সাবজেক্ট গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একটু পরেই তার ঘুম ভাঙ্গবে, তবে সাবজেক্ট হিসেবে নয়, সুলিভান হিসেবে! সুলিভান সাবজেক্টের হতে তার প্রিয় Smith and Wesson 442 পিস্তলটি গুঁজে দিলো। এর একটা বা একাধিক গুলিতে তার এতদিনের দেহকে সে নিজেই শেষ করে দিবে ভাবতেই তার মনে কেমন একটা শীতল অনুভূতি কাজ করছে।
সুলিভান Brain Emulation ডিভাইসের একপাশে সাবজেক্টকে রেখে আরেক পাশে নিজে বসে পড়লো। শেষবারের মত সব প্যারামিটার চেক করে সে ডিভাইসটি চালু করলো। বিদায় দেহ! বিদায়!
১৪ মে, ২৩৪৪। রাত ৩ টা ৪ মিনিট।
সুলিভান তার কস্কোভাস রোডের বাসার বারান্দায় একা বসে আছে। ২৮৮ বছর আগেও সে বসেছিলো এই বারান্দায়! একা!
সমাপ্ত