সারারাত জেগে থেকে শেষ পর্যন্ত রাত তিনটায় রাজিব তার অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করলো। খুব ক্লান্ত লাগছে তার। কোনমতে দাঁতটা ব্রাশ করেই বিছানায় গা টা এলিয়ে দিল সে। মুহূর্তেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল রাজিব......
রাজিব...রাজিব...এই রাজিব।
বন্ধু সাফকাতের কণ্ঠে নিজের নামটা শুনে ঘুমটা আবছাভাবে ভেঙ্গে গেল তার।
কি হয়েছে? এত রাতে ডাকছিস কেন?
কই রাত! ভোর হলো বলে। একটু পরেই আকাশে আলো ফুটবে। চল ছাদ থেকে ঘুরে আসি। অনেক গরম পরেছে। অনেকদিন তোর সাথে সকাল বেলা হাঁটা হয় না। চল।
অগত্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজিবকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হলো।
রাজিব যে বাড়িটায় ভাড়া থাকে সেটা আট তলা। সাত তলার ২ রুমের একটা ছোট্ট বাসায় সে, সাফকাত আর রাফসান থাকে। রাফসান এখন বাসায় নেই। ওর এখন ছুটি চলছে। সাফকাতও ছিলনা এক সপ্তাহ ধরে। মাঝে মাঝেই ডুব মারার অভ্যাসটা তার পুরনো। রাজিব তাই আর সাফকাতকে কিছু জিজ্ঞাস করলো না।
দুই বন্ধু মিলে ছাদের একদম কিনারায় এসে পা ঝুলিয়ে বসলো। রাজিবের চোখ থেকে ঘুম ঘুম ভাবটা এখনো যায় নি। বার বার খালি হাই আসছে তার।
দোস্ত, আমার খবর নিলি না কেন এই ক’টা দিন? আমার কথা এভাবে ভুলে গেলি? আমার তো কোনও বিপদও হতে পারতো।
রাজিবের ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গেল সাফকাতের এমন অনুযোগপূর্ণ কন্ঠ শুনে। সাফকাত কোনদিন এভাবে কথা বলেনি।
স্যরি দোস্ত। আমি আসলে ক্লাস নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম, সামনেই সেমিস্টার ফাইনাল তুইতো জানিস। আর কখনো এমন হবে না। আর তুই তো প্রায়ই এভাবে না বলে হারিয়ে যাস, ফোনটা পর্যন্ত অফ করে রাখিস। আমার কি দোষ বল?
হুম। আমিও স্যরি দোস্ত। অবেলায় তোদের ফেলে চলে গেলাম, এই মাস থেকে রাফসান আর তোকেই বাসা ভাড়াটা ভাগ করে দিতে হবে। আমার ড্রয়ারে হাজার খানেক টাকা আছে, চাইলে সেটা রাখতে পারিস, আর না রাখলে আমার মা কে পাঠিয়ে দিস। অনেকদিন বাড়ি যাই না, মা কে টাকা পাঠানোও হয় নি।
রাজিব ভীষণ ভয় পেয়ে গেল সাফকাতের এমন কথায়, অবাকও হলো। আমাদের ছেড়ে চলে গেলি মানে কি? কোথায় গেলি? পাগলামি করিস না তো। টাকা না থাকলে সমস্যা নাই, আমরা দুই জনেই বাসা ভাড়া দিব। কোথাও যেতে হবে না তোকে। আর খালাম্মাকে টাকাটা পাঠিয়ে দিস আজকেই, আমার কাছেও কিছু এক্সট্রা আছে, লাগলে নিস।
সাফকাত কিছু বলল না, একটু হাসলো শুধু।
আচ্ছা রাজিব তুই ঘুমোতে যা, সকাল হয়ে আসছে, তোর আবার ক্লাস আছে। আমি কিছুক্ষণ বসি এখানে একা।
আচ্ছা ঠিক আছে, বেশীক্ষণ বসে থাকিস না। তুইও একটু ঘুমা, না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে।
সাফকাত এবারও কিছুই বললো না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে একটু হাসলো।
রাজিব রুমের দরজাটা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো।
রাজিব...রাজিব...এই রাজিব।
এবার আর সাফকাত নয়, রাফসান ডাকছে রাজিবকে।
সকাল হয়ে গেছে। রাজিব বিছানা থেকে উঠে বসলো। সাফকাত হয়ত এখনো ঘুমাচ্ছে পাশের রুমে।
কখন আসলি বাড়ি থেকে? আর ছুটি তো এখনো বেশ ক’দিন আছে। চলে আসলি যে?
তুই কিছু জানিস না? সাফকাত গত পরশু রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছ। আমাকে ওর মা ফোন করে জানালো রাতে, তোকে অনেকবার ফোন দিয়েছিলাম, তোর ফোন অফ। তাই আর দেরি না করে চলে এলাম। চল রেডি হয়ে নে, সাফকাতের বাড়ি যেতে হবে।
রাজিব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না! রাফসান নিশ্চয়ই তার সাথে মজা করছে!
রাফসান, ফাজলামি করিস না তো। আমি সকালেই সাফকাতের সাথে ছাদে বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। আর তুই বলছিস ও দুইদিন আগে মারা গেছে। মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে ফাজলামি আমার একদম ভালো লাগে না বলে দিলাম।
রাফসান আমার চেয়ে আরও বেশি অবাক হলো। না দোস্ত আমি সত্যি বলছি, তোর কোথাও ভুল হচ্ছে, কাল নিশ্চয়ই রাত জেগেছিলি? স্বপ্ন দেখেছিস!
রাজিব প্রচণ্ড রেগে গেল রাফসানের কথা শুনে। আরে আমি স্বপ্নে দেখলে বুঝি বুঝতাম না এতক্ষণে? সাফকাত বলেছিল ওর ড্রয়ারে হাজার খানেক টাকা আছে, ওর মাকে পাঠাবে। পারলে গিয়ে দেখে আয় ওর ড্রয়ারে।
রাফসান দৌড়ে গেল সাফকাতের রুমে, তার ড্রয়ার খুলেই দেখল দুই হাজার টাকা রাখা আছে একপাশে, সাথে কিছু খুচরো পয়সা। রাফসান ভীষণ অবাক হলো। রাজিব, চল আর দেরি না করে সাফকাতের বাড়ি যাই, সেখানে গিয়েই দেখি ব্যাপারটা কি। আর সময় নষ্ট করিস না।
রাজিব দ্রুত রেডি হয়ে রাফসানের সাথে রওনা দিল। গাবতলি থেকে বাসে উঠে পড়লো দুই বন্ধু। সিটে বসার একটু পড়েই রাজিব ঘুমিয়ে পড়লো।
রাজিব...রাজিব...
রাজিব এবার আর চোখ খুললো না। চোখ না খুলেই সে দেখলো তার দুই বন্ধু, সাফকাত আর রাফসানের কান্না ভেজা চোখ-মুখ। শুধু তার বন্ধুরা নয়, তার বাবা-মা, এলাকার সবাইও আছে। সবাই কান্না করছে। রাজিব কিছু বুঝতে পারছে না। উঠে বসার চেষ্টা করলো সে, পারলো না। তার মা কে ডাকার চেষ্টা করেও পারলো না। রাজিব বড্ড অসহায় বোধ করলো। আস্তে আস্তে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসলো। হয়ত আবার ঘুম আসছে তার।
রাজিব দুইদিন আগে ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। যেদিন মারা যায় সেদিন সন্ধ্যায় সাফকাতকে দুই হাজার টাকা দিয়ে রাজিব তার বাড়িতে পাঠাতে বলেছিল। সামনে পরীক্ষা, বাড়ি যাবার সময় নেই তার হাতে। সত্যি সময় নেই............
*** পৃথিবী ছেড়ে আমাদের চলে যাওয়া শুধুই আমাদের চলে যাওয়া নয়। আমরা পৃথিবী থেকে ছোট ছোট অনেকগুলো গল্পের অনুষঙ্গ সাথে করে নিয়ে যাই। তাই অনেকগুলো ছোট গল্প কখনো কেউ জানতেও পারে না......
সমাপ্ত